মহেশখালীতে কোস্টগার্ডের অভিযানে বিএনপি নেতা মোঃ আলী-নাজু মাতাব্বারসহ নিরীহ মানুষ গ্রেফতার: শহীদ তানভীর পরিবারের সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ
“কোটি টাকার কন্ট্রাক্টে কালারমারছড়ার নিরীহ মানুষদের বস্তা বস্তা অ/স্ত্র দিয়ে কোস্টগার্ডের সাজানো অভিযান”; অভিযোগে যা বললেন ভুক্তভোগীরা
কক্সবাজার প্রতিনিধি
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ায় কোস্টগার্ডের বিতর্কিত অভিযান, গ্রেপ্তারকৃত বিএনপি নেতা মোহাম্মদ আলী ও মাছ ব্যবসায়ী নাজেম উদ্দিন মাতাব্বারসহ নিরহদের সকলকে নিঃশর্ত মুক্তির দাবীসহ লুটপাট ও হয়রানি বন্ধের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর পরিবার ও বিএনপি সমর্থিত কয়েকটি পরিবার। ২১ অক্টোবর মঙ্গলবার সকাল ১১টায় কক্সবাজার উপকূলীয় সাংবাদিক ফোরামের কক্সবাজারস্থ কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা বলেন, সাম্প্রতিক কোস্টগার্ড অভিযান ছিল পরিকল্পিত, উদ্দেশ্যমূলক এবং সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতির মধ্যে রাখার একটি প্রচেষ্টা।
সংবাদ সম্মেলনে নিহত তানভীরের স্বজন মোহাম্মদ আলীর কন্যা কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী নিঝুম মনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় এক পলাতক আওয়ামীলীগের পলাতক গডফাদার তারেক শরীফের ইন্ধনে ও অর্থায়নে কোস্টগার্ড বারবার তাদের বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। তিনি বলেন, নিরীহ মানুষকে ধরে এনে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে, যা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জন্য দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। তাঁর দাবি, নিরপেক্ষ তদন্ত করলে প্রমাণ হবে যে, এসব অভিযান প্রকৃত অপরাধী ধরার জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টার্গেট করার উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে।
ভুক্তভোগী পরিবারের আরেক সদস্য জেসমিন আক্তার বলেন, আমাদের নিরপরাধ পরিবারের উপর কোস্টগার্ডের এই জুলুম বন্ধ হোক। আমরা বিচার চাই। তিনি আরও বলেন, গত ১৮ অক্টোবরের অভিযানে অনেক সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ ওই সময় প্রকৃত দাগি সন্ত্রাসীরা ছিল অদৃশ্য। অভিযানে স্থানীয়ভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। পরিবারগুলোর দাবি, অভিযানের নামে মহেশখালীতে ভয় ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে, যা প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।
অভিযোগ উঠেছে, ১৮ অক্টোবরের অভিযানে কোস্টগার্ড অস্ত্র উদ্ধারের নামে লোকালয়ে নাটক মঞ্চস্থ করে। স্থানীয়রা জানান, মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার সহযোগিতায় কোস্টগার্ড ওই অভিযান পরিচালনা করে। অভিযোগ রয়েছে, তার কয়েকজন আত্মীয়ও কোস্টগার্ডে কর্মরত। এ কারণে তাঁর প্রভাব ব্যবহার করে বিতর্কিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি একাধিক মামলার আসামি হলেও কোস্টগার্ডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁকে প্রভাবশালী অবস্থানে রেখেছে বলে এলাকাবাসীর দাবি।
সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী পরিবার বলেন, ১৮ অক্টোবরের অভিযানে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার না করে নিরীহ মৎস্যজীবী, কৃষক ও ছাত্রদের আটক করা হয়। পরদিন ১৯ অক্টোবর মহেশখালী থানায় দায়ের করা মামলায় শহীদ তানভীরের ভাই মোহাম্মদ আলী, চাচা নাজেম উদ্দিন মাতব্বর, যুবদল কর্মী সবুজ, কৃষক আতিকুর রহমান ও মানিকসহ ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। স্থানীয়রা জানান, এরা কেউই সন্ত্রাসী নয়, বরং সবাই সাধারণ পেশাজীবী মানুষ, যাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়রানি করা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, কোস্টগার্ডের অভিযানের সময় কয়েকজন সোর্স নামধারী ব্যক্তিকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, ১০ থেকে ১৫ জনের একটি দল অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে উপস্থিত। স্থানীয়রা বলেন, এটি কোনো দুর্গম এলাকা নয়; বরং বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং কৃষিজমি নিয়ে গঠিত একটি সাধারণ গ্রাম। তাই এলাকাকে ‘অপরাধীদের ঘাঁটি’ হিসেবে প্রচার করা উদ্দেশ্যমূলক বলে দাবি তাদের।
স্থানীয় শিক্ষক আবু তাহের বলেন, অভিযান দরকার ছিল পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে আসল সন্ত্রাসীরা অবস্থান নেয়, কিন্তু অভিযান হয়েছে লোকালয়ে। তিনি মনে করেন, এ ধরনের পদক্ষেপে সাধারণ মানুষ প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। মহেশখালীর অনেক বাসিন্দাই জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় বারবার অভিযান চালিয়ে নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, অথচ সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থেকে যাচ্ছে নিরাপদে। ফলে এলাকায় ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, এর আগেও একই কায়দায় মহেশখালীর কালারমারছড়ার ঝাপুয়া এলাকায় তিন ভাইকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। পরে তদন্তে দেখা যায়, তারা স্থানীয় বাসিন্দা ও নিরীহ শ্রমজীবী মানুষ। একইভাবে ৮ এপ্রিল রাতে কোস্টগার্ডের অভিযানে গুলিতে এক মাছ ব্যবসায়ী ও এক যুবক নিহত হন। এসব ঘটনায় মানববন্ধন হলেও এখনো কোনো বিচার হয়নি। ফলে জনগণের মনে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা বলেন, আমাদের নিরীহ আব্বুকে ফিরিয়ে দিন, অন্যায় মামলা প্রত্যাহার করুন। তাঁরা কোস্টগার্ডের অভিযানে রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থ লেনদেন ও প্রতিশোধের মনোভাব কাজ করছে বলে অভিযোগ করেন। তাদের দাবি, অবিলম্বে বিতর্কিত অভিযান বন্ধ, আটক ব্যক্তিদের মুক্তি এবং ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত নিশ্চিত করা হোক। একই সঙ্গে তারা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন, শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর ভাইপো মোহাম্মদ শিপন, কলেজ পড়ুয়া ছাত্র মোহাম্মদ সোহাগ, আসিফ, ছাত্রদলের নেতা তানিশ প্রমূখ।
এ নিয়ে কোস্টগার্ডের মিডিয়ার দায়িত্বে থাকা আমিনুল হক জানান, কোন নিরপরাধ ব্যক্তিদের আটক করা হলে তা যাচাই-বাছাই করা হবে। মিডিয়ায় দুর্গম পাহাড়ে অভিযান চালানোর কথা বললেও মূলত কোস্টগার্ড সমতল ভূমিতে অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে আটক করে।

0 মন্তব্যসমূহ