এরফান হোছাইন:
মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার আট বছর পূর্তি হতে চললেও এই মানবিক সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান আজও মেলেনি। এই প্রেক্ষাপটে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি টেকসই ও কার্যকর সমাধান চাইছে।
এই লক্ষ্যেই রবিবার (২৪ আগস্ট) থেকে কক্সবাজারের উখিয়ায় তিন দিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে, যেখানে ৪০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। এই আয়োজনকে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিতব্য রোহিঙ্গা সংকট সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মূল অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সোমবার (২৫ আগস্ট) সকালে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উখিয়ার ইনানী সৈকতের হোটেল বে-ওয়াচে আয়োজিত 'রোহিঙ্গা বিষয়ক অংশীজন সংলাপ' শীর্ষক এই সম্মেলনে তিনি রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "রোহিঙ্গারা যাতে মর্যাদা ও নিরাপত্তার সাথে দ্রুত নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে, সে লক্ষ্যে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।"
ড. ইউনূস বলেন, ২০১৭ সালের এই দিনে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো প্রতিদিন নতুন করে রোহিঙ্গা আসছে। তিনি উল্লেখ করেন, যদি আমরা রাখাইন সম্প্রদায়ের শেষ চিহ্নটুকু দেখার জন্য অপেক্ষা করি, তাহলে তা হবে একটি সাংঘাতিক ভুল।
টেকসই সমাধানে ৭ দফা কর্মপরিকল্পনা
প্রধান উপদেষ্টা এই মানবিক সংকট সমাধানে সাতটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রস্তাব করেন, যা জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা করা হচ্ছে:
১. নিরাপদ প্রত্যাবাসন: দ্রুত একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরি করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক এবং টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে।
২. অর্থায়ন: রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় দাতাগোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক অংশীজনদের মানবিক সহায়তার জন্য পর্যাপ্ত ও টেকসই অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে।
৩. নিপীড়ন বন্ধ: মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এবং আরাকান আর্মির প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ করে তাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং জীবিকা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।
৪. সংলাপ: মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সহিংসতা বন্ধে এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে।
৫. আঞ্চলিক ভূমিকা: আসিয়ান জোটসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইনে স্থিতিশীল ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
৬. জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার: আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের অবশ্যই জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং এটি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৭. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়।
সফর ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
প্রধান উপদেষ্টার আগমনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের এক বিজ্ঞপ্তিতে আগ্নেয়াস্ত্রধারীদের তাদের অস্ত্র নিজ নিজ থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সাধারণ জনগণকে নিরাপত্তা বিধানে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সম্মেলনের প্রথম দিনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমানসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে বিদেশি কূটনীতিক, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক প্রতিনিধি, বৈশ্বিক সংস্থা ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। সম্মেলনের শেষ দিন ২৬ আগস্ট বিদেশি অতিথিরা উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন। এই ধরনের সম্মেলন বৈশ্বিক মঞ্চে রোহিঙ্গা সংকটকে সচল রাখতে এবং সমাধানের পথ উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ