রামুতে সরকারি দপ্তরের রেষারেষি: বনভূমি নিয়ে প্রশাসন ও বন বিভাগের তীব্র দ্বন্দ্ব
কক্সবাজারের হিমছড়িতে বন বিভাগের স্থাপনা ভাঙাকে কেন্দ্র করে উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। 'খাস জমি' ও 'গেজেটেড বনভূমি'র দাবির মুখে প্রকাশ্যে এসেছে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাকবিতণ্ডার ভিডিও, যা জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের।
এরফান হোছাইন:
কক্সবাজারের রামু উপজেলার হিমছড়ি এলাকা এখন সরকারি দুই দপ্তরের ভূমি বিরোধের উত্তপ্ত কেন্দ্র। সম্প্রতি বন বিভাগের একটি স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নজিরবিহীন সংঘাত। উপজেলা প্রশাসনের দাবি, এটি সরকারি খাস জমি; অন্যদিকে বন বিভাগ বলছে, এটি তাদের গেজেটেড বনভূমি। এই পরস্পরবিরোধী দাবির জের ধরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সাজ্জাদ জাহিদ রাতুলের নেতৃত্বে বন বিভাগের নির্মিতব্য ও পুরনো স্থাপনার অংশবিশেষ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বন বিভাগ এটিকে বিনা নোটিশে সম্পূর্ণ বেআইনি হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
প্রকাশ্যে বাকবিতণ্ডা: "আমাকে কথা বলা শিখাচ্ছেন, আপনি কে?"
এই অভিযানের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দিক হলো সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সাজ্জাদ জাহিদ রাতুল এবং কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের কর্মকর্তা ডিএফও নুরুল ইসলামের মধ্যে তীব্র বাকবিতণ্ডা। গত শুক্রবার (২৫ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে এসিল্যান্ড রাতুলকে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় ডিএফওকে বলতে শোনা যায়, "আমাকে কথা বলা শিখাচ্ছেন, আপনি কে? আমাকে কিভাবে কথা বলতে হয় আপনার কাছে শিখতে হবে?" এই ঘটনা সরকারি দুই দপ্তরের চলমান ভূমি বিরোধকে জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে এবং ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ভিডিও প্রসঙ্গে রামু উপজেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) বিকেলে হিমছড়ি টহল ফাঁড়িতে দক্ষিণ বন বিভাগের নির্মিতব্য সহব্যবস্থাপনা কমিটির ভবনের জায়গাকে কেন্দ্র করেই এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড়: "ভূমিদস্যুদের দখলে হাজারো একর জমি, তবুও সংঘাত!"
এই ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কক্সবাজার ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাংবাদিক জসিম উদ্দিন ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন, "কক্সবাজারে হাজার হাজার একর খাস ও বনভূমি দস্যুদের দখলে—তবু সেসব উদ্ধারে নেই কোনো উদ্যোগ। কিন্তু ছোট্ট এক টুকরো জমি নিজেদের মালিকানা দাবি করে রামুতে উপজেলা প্রশাসন ও বন কর্মকর্তাদের মুখোমুখি সংঘাতে!"
আবু সায়েম নামের একজন ফেসবুকে এসিল্যান্ডের আচরণ নিয়ে সমালোচনা করে লিখেছেন, "বনবিভাগ বলছে তাদের কাগজ আছে। এসিল্যান্ড বলছে আমাকে ডিসি উচ্ছেদ করতে পাঠিয়েছে। উচ্ছেদ করবেন ভালো কথা, কিন্তু একজন ডিএফওর সামনে রামুর এসিল্যান্ডের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ কোনো মতে কাম্য নয়।" আরেক বন কর্মকর্তা রোকনজ্জামান রোকন নিজের ফেসবুক পোস্টে প্রশ্ন তুলেছেন, "একজন সরকারি কর্মচারী আরেকজন সরকারি কর্মচারীকে এভাবে কথা বলার এখতিয়ার কিংবা অধিকার রাখে কিনা জানি না।"
প্রশাসনের ভাষ্য: "বিনা অনুমতিতে স্থাপনা নির্মাণ"
রামুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশেদুল ইসলাম দৈনিক পূর্বকোণকে জানিয়েছেন, খাস খতিয়ানভুক্ত জায়গায় বন বিভাগ বিনা অনুমতিতে স্থাপনা নির্মাণ করায় এসিল্যান্ড সেটি ভাঙতে গিয়েছিলেন। তবে সেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় এবং বন কর্মকর্তারা বাধা দেওয়ায় উচ্ছেদ অভিযান সম্পন্ন করা যায়নি। ভবিষ্যতের পদক্ষেপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জেনেছে এবং তাদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে, স্থাপনাটি উচ্ছেদ হবে কি থাকবে, সে বিষয়ে আপাতত কিছু বলতে পারেননি তিনি।
বন বিভাগের অভিযোগ: "গেজেটেড বনভূমি, বিনা নোটিশে ভাঙচুর"
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) নুরুল ইসলাম দৈনিক পূর্বকোণকে জানান, ২০১০ সালে এই জায়গাটি বন বিভাগের জন্য গেজেটেড করা হয় এবং ১৯০৫ সালে এটিকে রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তিনি অভিযোগ করেন, গত ২৪ জুলাই কোনো লিখিত বা মৌখিক নোটিশ ছাড়াই হঠাৎ করে বন বিভাগের স্থাপনাগুলো ভেঙে দেওয়া হয়। ডিএফও বলেন, প্রায় এক মাস ধরে তাদের দ্বিতল ভবনের কাজ চলমান থাকলেও শুরুতে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। তিনি আরও জানান, তাদের গেটের পাশে একটি টিকেট কাউন্টার করার জন্য তারা প্রশাসনের গেট ও বাথরুম সরিয়ে নিতে বলেছিলেন, কিন্তু তারা তা না করায় বন বিভাগ নিজেই সেগুলো সরিয়ে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশাসন তাদের জায়গায় নির্মিত পুরাতন স্থাপনা, নতুন ভবনের পিলার, গোলঘর ও সীমানা প্রাচীর ভেঙে দিয়েছে।
ডিএফও নুরুল ইসলাম আরও অভিযোগ করেন, অভিযানকালে এসিল্যান্ড তার কাছে থাকা কাগজপত্র দেখতে চাননি, উল্টো তাকে ধমক দিয়েছেন এবং জোরপূর্বক ভাঙচুর চালিয়েছেন। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী গেজেটেড বনভূমিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা উচ্ছেদ করতে হলে সরকারের ২৬ ধারার নির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা সরকার ব্যতীত অন্য কোনো সরকারি দপ্তর বা জেলা প্রশাসন করতে পারে না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জেলা প্রশাসক দ্রুত এ বিষয়ে বন বিভাগের সঙ্গে বসে একটি সমাধান করবেন।
সমন্বয়হীনতার ফল?
সচেতন মহল মনে করছেন, এই ঘটনা কক্সবাজারের ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং সরকারি দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে আবারও সামনে এনেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, যেখানে হাজার হাজার একর সরকারি জমি ভূমিদস্যুদের দখলে, সেখানে সরকারি দুই দপ্তরের মধ্যে এমন সংঘাত জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই দ্বন্দ্বের শেষ কোথায়, তা দেখার অপেক্ষায় এখন সবাই।
0 মন্তব্যসমূহ