রোহিঙ্গা সংকট: সমাধানের খোঁজে বিশ্ব শরণার্থী দিবসে কক্সবাজারে সেমিনার



বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আলোচনা; স্থানীয় সংহতি ও দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জোর

এরফান হোছাইনঃ
রোহিঙ্গা সংকট নিরসন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সংহতি জোরদারের লক্ষ্যে কক্সবাজারে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ব শরণার্থী দিবস ২০২৫ (১৯ জুন) উপলক্ষে কোস্ট ফাউন্ডেশনের আয়োজনে 'Dialogue- Community Level Seminar' শীর্ষক এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) কক্সবাজারের অরুনাদয় হাউসের অডিটোরিয়ামে সকাল ১০:৩০টা থেকে দুপুর ২:০০টা পর্যন্ত এই মতবিনিময় সভা চলে।

সেমিনারের মূল উদ্দেশ্য হলো শরণার্থী অধিকার এবং দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ ও টেকসই সমাধান নিয়ে আলোচনা করা। ইউএনএইচসিআর (UNHCR) ও ইউএনএইচসিএইচআর (UNHCHR)-এর সহায়তায় COAST ফাউন্ডেশন 'Strengthening Peaceful Co-Existence Project' প্রকল্পের আওতায় এই সেমিনার আয়োজন করেছে।


আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ও অংশগ্রহণকারী

সেমিনারের আলোচ্য সূচিতে শরণার্থী অধিকার ও দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গাদের জন্য সম্ভাব্য সমাধান, বিশেষ করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে ইউএনএইচসিআর কক্সবাজার অফিসের প্রধান, ডব্লিউএফপি (WFP) প্রতিনিধি, আইএসসিজি (ISCG) সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় এনজিও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

আলোচনা সভায় বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং স্থানীয় যুব সংগঠনের সদস্যরা এই সংলাপে অংশ নিয়েছেন।


বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে প্রায় ১১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৮১ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ৩৩টি ক্যাম্প কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের পর গত ১২ মাসে আরও ১ লাখ ১৮ হাজার ২১৪ জন রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে বর্তমানে ১৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফে বসবাস করছে বলে নিশ্চিত করেছেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রেজা।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ১৯৫১ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি; বাংলাদেশ সরকার তাদের 'বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক' (FDMNs) হিসেবে বিবেচনা করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ৪ লাখ ৩১ হাজার জন শিশু, যুবক ও কিশোর রয়েছে, যা মোট রোহিঙ্গা জনসংখ্যার ৪৩.৪ শতাংশ। এই বিশাল জনগোষ্ঠী প্রায় ৮০০ একর বনভূমির উপর নির্ভরশীল।


স্থানীয়দের উদ্বেগ ও আন্তর্জাতিক এনজিওর ভূমিকা

কক্সবাজার গ্র্যাজুয়েট প্রেসক্লাবের যুগ্ন আহবায়ক মোঃ আব্দুল্লাহ বিন ম্যাক্স তার বক্তব্যে বলেন, স্থানীয় কক্সবাজারবাসীর চাকরি গেলেও রোহিঙ্গা সহ জেলার বাইরের বা উত্তরবঙ্গ থেকে আসা লোকদের চাকরিচ্যুতির ঘটনা দেখা যায় না। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি ২৫ শতাংশ স্থানীয়দের জন্য প্রাপ্ত ফান্ডিং সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রায় ৪ হাজারের বেশি শিক্ষকের চাকরি নেই যেখানে ফান্ডিং নেই বলে প্রচার করা হচ্ছে, অথচ সেসব শিক্ষকদের সহকর্মীরা যারা রোহিঙ্গা তাদের চাকরি বহাল রয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার বৈষম্য থেমে নেই স্থানীয়দের জন্য এবং বার বার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও স্থানীয়দের অধিকার আদায়ের বিপক্ষে কাজ করছে।

এনজিও প্লাটফর্ম হিউম্যানিটেরিয়ান এক্সেস কোর্ডিনেটর মার্কো মিলজেভিচ বলেন, তিনি রোহিঙ্গা সহ বাস্তুচ্যুত এলাকায় ২০ বছর কাজ করেছেন এবং অনেকবার চাকরি হারিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, তার চাকরি না থাকলে কী হয় তা তিনি বোঝেন এবং সে হিসেবে কক্সবাজারে ইতিমধ্যে কয়েক হাজার স্থানীয় কক্সবাজারবাসী চাকরিচ্যুত হয়েছে, যা দুঃখজনক। তিনি আন্তর্জাতিক মহলে এই বিষয়ে 'ভয়েস রেইস' করার আহ্বান জানান যাতে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সমস্যা না বাড়ে।


ভবিষ্যতের পথ ও সুপারিশ

মানবিক সহায়তা, ওয়াশ (WASH), শিক্ষা ও শিশু সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে তহবিল ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, যার ফলে স্টাফ কমা এবং শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয়দের সাথে সহাবস্থান বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। অনুষ্ঠানের অন্যতম হোস্ট রেজাউল করিম রেজা জানান, এই সেমিনারে বিভিন্ন শ্রেণীর অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য থেকে প্রাপ্ত সুপারিশমালা ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ