খেজুর গাছে বাবার ভ'য়ংকর সেই ভ'য়াল রাত - এহছানুল হক

 


#ওই রাতেই চিরতরে হারিয়ে যান বাবার বোন, বোনের ১ ছেলে ও ২ মেয়ে


এহছানুল হক


১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। আমার বয়স ৩ বছর। ৬ বোনের আমিই একমাত্র ভাই। বেড়ার ঘরে সুখের দিন কাটছিল আমাদের। ঘূর্ণিঝড়ে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র বলতে ছিল আমাদের একতলা মসজিদ (ছৈধন মাতবর বাড়ি জামে মসজিদ)। আকাশের অবস্থা বেগতিক দেখে ওইদিন মা রান্না করেন মোরগ আর বিনিভাত। সাইক্লোনের আশঙ্কা দেখে মাগরিবের পরই সবাই রাতের খাবার সেরে নিই। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে বৃষ্টি-বাতাস। এরই মধ্যে বাবা একেক করে সবাইকে আশ্রয়ে মসজিদে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমিও ছিলাম মায়ের কোলে। যাওয়ার পথে হঠাৎ প্রচণ্ড বাতাস শুরু হলে মা আমাকে নিয়ে পুকুরে পড়ে যাচ্ছিলেন, গাছ ধরে বেঁচে যাই আমি ও মা। আমরা কোনমতে মসজিদে আশ্রয় নিই। সেখানে গিয়ে দেখি সহায় সম্ভল নিয়ে পড়ার সকলে মসজিদে আসতে থাকেন। মসজিদের একতলা খোলা ছাদে ছিল দেড় কিংবা দুইহাত রেলিং। এই ছাদে বৃষ্টি আর প্রচণ্ড বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে ভয়ঙ্কর রাত কাটালেন সবাই। এরমধ্যে বহু শিশুও ছিল। মানুষের চাপ এতই বেড়েছিল মসজিদের ছাদে উঠা একসময় কঠিক হয়ে পড়েছিল- বিশেষ করে শিশুদের। এমনও হয়েছিল সিঁড়ি বেয়ে একতলা ছাদে তুলতে না পেরে শিশুদের নিচ থেকে ছাদে ছুড়ে মারতে হয়েছিল। এতে অনেক শিশু মা-বাবা থেকে আলাদা হয়ে যায়। তবে সেদিন একে অপরের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মতো আকড়ে ধরে রক্ষা করেছেন। 

আমরা সবাই মসজিদে আশ্রয় নিলেও ঘর ভেসে যাবে এ কথা ভেবে বাবা থেকে যান বাড়িতে। অনেকে সাহস করে বাবাকে আনতে গেলেও বাতাসের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। আমাদের বাড়ির পাশে একটি খেজুর গাছ ছিল। এক পর্যায়ে যখন পানি আসতে শুরু করে তখন বাবা ঘরের চাল রশি দিয়ে খেজুর গাছে বেঁধে ফেলেন এবং ওই গাছে আশ্রয় নেন। ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে বাতাস-২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে খেজুর গাছটি আকড়ে ধরে সারারাত বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করেন বাবা। গায়ে খেজুর গাছের কাটার যন্ত্রণা নিয়ে তিনি সেই রাতে দেখলেন- তীব্র স্রোতে দোলনায় ভেসে যাওয়া শিশু, বহু জীবন্ত মানুষ ও লাশ। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি-বাতাসে গাছেই এক ভয়ানক রাত কাটালেন বাবা।

সেদিন রাতেই ঘরের চাল ছাড়া নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পুরো ভিটা। পানির স্রোত এতই বেশি ছিল যে- আমাদের ভিটের মাটি পর্যন্ত উপড়ে নিয়ে গেছে। বাবা মারা গেছেন মনে করে সকালে সবাই কান্না করছিলাম। পরে আমাদের বংশের কয়েকজন গিয়ে বাবাকে জীবিত উদ্ধার করেন। 

আজ সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল। এই দিনে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চল। এই তাণ্ডব থেকে বাদ যায়নি আমার গ্রাম পেকুয়ার রাজাখালী মাতবর পাড়াও।  সেদিন কক্সবাজারে প্রায় দেড় লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়। মারা যায় অগণিত গবাদি পশু, নিশ্চিহ্ন হয় গাছপালা-ঘরবাড়ি। 


সেদিন রাতেই ভেসে যান আমার বাবার বোন (মাস্টার মোহাম্মদ হোছাইনের ছেলে মোরশেদ কামালের মা) ও বোনের এক ছেলে ও ৩ মেয়ে। এর মধ্যে ফুফাত বোন তসলিমা আক্তার বেঁচে ফিরলেও একেবারেই চিরকালের জন্য হানিয়ে যান আমার ফুফি, তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা খড়ের গাদায় (কুইজ্জা) আশ্রয় নিলেও টেউয়ের তোড়ে ভেসে যায়। এর মধ্যে নিউ টেনে (দশম শ্রেণি) পড়ুয়া ফুফাত বোন তসলিমা পানিতে ভেসে আসা গাছ আকড়ে ধরে বেঁচে যান। দুইদিন পর বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে নাপিত খালি থেকে তাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তবে সেই রাতে বাবার সঙ্গে গাছ ধরে বেঁচে যায় ফুপাত ভাই ১০ বছরের শিশু মোরশেদ কামাল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ